আসসালামুআলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ।
সুপ্রিয় দর্শক মন্ডলী আশা করি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অশেষ মেহেরবানি ও দয়ায় আপনারা সবাই ভাল আছেন।
প্রিয় দর্শক
‘শব’ বা ‘লাইল’ অর্থ রাত। আর ‘কদর’ অর্থ মর্যাদা। শবে কদর বা লাইলাতুল কদর অর্থ ‘মর্যাদার রাত’। কোনো কোনো আরবি অভিধানের বর্ণনা মতে ‘কদর’ শব্দের অর্থ ‘ভাগ্য’ ধরে এ রাতকে ‘ভাগ্য নির্ধারণ রজনী’ও বলা হয়। লাইলাতুল কদরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো- এ রজনীতে ঐশীগ্রন্থ পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে।
পবিত্র রমজান মাসে আল্লাহ তাআলা উম্মতে মোহাম্মাদীর জন্য ‘শবে কদর’ নামে এমন এক পুরস্কার দান করেছেন, যা অন্য কোনো নবীর কোনো উম্মতকে দান করা হয়নি।
চলুন জেনে নেই,
১. লাইলাতুল কদর কবে?
নির্দিষ্ট করে ‘লাইলাতুল কদর’ চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। কারণ এ রজনীকে নির্দিষ্টকরণমূলক কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। অনেকেই মনে করেন, ২৬ রমজান দিবাগত রাতটিই লাইলাতুল কদর। এমনটা ধারণা করা কোনোভাবেই সঠিক নয়। পবিত্র রমজান মাসের শেষ দশকের যে কোনো একটি বেজোড় রাতই ‘শবে কদর’ হতে পারে।
বোখারী শরীফের ৭০৯ নং হাদীসে নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছে, অতঃপর আমাকে তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অতএব তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতসমুহে তা খোঁজ করবে।’
২. শবে কদর কেন এতোটা গুরুত্বপূর্ণ?
বোখারী ও মুসলিম শরীফে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রেখে তার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সওয়াবের আশায় ইবাদত করবে,, তার আগের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’
তাফসীরে মারেফুল কোরআন ও তাফসীরে মাজহারিতে উল্লেখ হয়েছে, ‘রাসুল (সা.) একবার সাহাবায়ে কেরামকে বনী ইসরাইলের একজন আবিদ ও জাহিদ ব্যক্তির আমল-আখলাকের ঘটনা শুনাচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, সেই আবিদ ব্যক্তি হাজার মাস বিরতিহীনভাবে সারারাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী, জিকির-আজকার করতেন এবং সারাদিন সিয়াম পালন করতেন ও আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করতেন।
সাহাবা আজমাইনরা ঐ ব্যক্তির আমলের বর্ণনা শুনে নিজেদের স্বল্প আয়ূর কথা স্মরণ করে আফসোস করছিলেন। এমন সময় সূরা কদর নাজিল হলো এবং তাতে ইরশাদ হলো- ‘হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হচ্ছে লাইলাতুল কদর।’ অর্থাৎ মাত্র একটি রাত না ঘুমিয়ে ইবাদত-বন্দেগী, জিকির-আজকারসহ বিভিন্ন নেক আমলে সময় কাটাতে পারলে হাজার মাস লাগাতার ইবাদত করার চেয়েও অনেক বেশি সওয়াব অর্জন করা সম্ভব হতে পারে।
৩. কদরের রাত চেনার কোনো আলামত আছে কী?
যে রাতটি লাইলাতুল কদর হবে সেটা চেনার কিছু আলামত বা কিছু নিদর্শনের কথা বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। বোখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ ও ইবনে খুমাইমাসহ বিভিন্ন হাদীসের গ্রন্থে এ রাতের আলামত বা নিদর্শনের কথা আলোচিত হয়েছে। সেগুলো হলো-
আলামত- ১: রমজানের ২৭তম রজনী অর্থ্যাৎ ২৬ রমজান দিবাগত রাতটি লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী। মুসলিম শরীফে এসেছে, রাসুল (সা.) থেকে হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.) বর্ণনা করে বলেন, ‘আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি যতদূর জানি রাসুল (সা.) আমাদেরকে যে রজনীকে কদরের রাত হিসেবে কিয়ামুল্লাইল করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন; তা হলো- রমজানের ২৭ তম রাত।’
আলামত- ২: রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না। অর্থাৎ এ রাতের অন্ধাকারচ্ছন্নতা অন্য রাতের তুলনায় কম হবে।
আলামত- ৩: সে রাতের আবহাওয়া হবে নাতিশীতোষ্ণ। অর্থাৎ গরম বা শীতের তীব্রতা থাকবে না সে রাতে।
আলামত- ৪: মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে গোটা রাত জুড়ে।
আলামত- ৫: সে রাতে ইবাদত করে মানুষ অপেক্ষাকৃত অধিক তৃপ্তিবোধ করবে।
আলামত- ৬: কোনো ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ মহান স্বপ্নে রাতটির কথা হয়তো জানিয়েও দিতে পারেন।
আলামত- ৭: ঐ রাতে বৃষ্টি বর্ষণও হতে পারে।
আলামত- ৮: সে রাতের সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে। সেদিন সকালের প্রথম সূর্যটি হবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো।
৪. নিশ্চিতভাবে শবে কদর লাভের কোনো আমল আছে কী?
নিশ্চতভাবে শবে কদর লাভ করা অত্যন্ত সৌভাগ্যজনক একটি বিষয়। রমজানের কোন রাতটি শবে কদর বা লাইলাতুল কদর হবে সেটা যেহেতু নিশ্চিত বা সুচিহ্নিত নয় সুতরাং নিশ্চিতভাবে শবে কদর বা লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির দাবী করাও খুব কঠিন। তবে রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করার মাধ্যমে অনেকটাই নিশ্চিতভাবে মহিমান্বিত এই রজনীটি লাভ করা সম্ভব হতে পারে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন ইসলামী বিশেষজ্ঞগণ। কারণ ইতিকাফ করার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হলো- শবে কদর প্রাপ্তি। সুতরাং রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করার মাধ্যমে শবে কদর প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়।
৫. এ রাতে মুসলিম হিসেবে করণীয়,
করণীয়: মহিমান্বিত এ রজনীতে প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য করণীয় কিছু আমল রয়েছে। কারণ এ রাতটি বছরে একবারই আসে এবং একটি কদরের রাত পাওয়ার অর্থ হলো- হাজার মাস একনিষ্টভাবে মহান প্রভূর ইবাদত কাটানোর সৌভাগ্য অর্জন করা।
সুতরাং প্রত্যেক মুসলমানের
প্রথম করণীয় হলো- পবিত্র রমজানের শেষ দশকের প্রতিটি বেজোড় রাত যেকোনো মূল্যে ইবাদত-বন্দেগীতে কাটানোর নিয়ম করে প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
দ্বিতীয় করণীয় হলো- প্রতিটি বেজোড় রাতে মাগরিব, ইশা এবং ফজরের নামাজ অবশ্যই জামাতের সঙ্গে মসজিদে আদায় করা।
তৃতীয় করণীয় হলো- সালাতুত তাসবীহ ও বিভিন্ন নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকারসহ যে কোনো ধরনের নেক আমলে সময় কাটানো।
চতুর্থ করণীয় হলো- বেশি বেশি তাওবা-দোয়া-মোনাজাত করা।
পঞ্চম করণীয় হলো- এ রাতে দান-সাদাকাহ করাকেও অধিক উত্তম বলা হয়েছে।
৬. এ রাতে মুসলিম হিসেবে বর্জনীয়ঃ
অনেক মুমিন-মুসলমান ভাই-বোন এ রাতে কবর জিয়ারত করে থাকেন। কদরের রাতে কবর জিয়ারত করার কোনো সহিহ বর্ণনা রাসুল (সা.) থেকে পাওয়া যায় না। সুতরাং ভালো হলেও লাইলাতুল কদরে কবর জিয়ারত করা থেকে বিরত থেকে অন্য আমল-ইবাদতে মশগুল থাকা অধিক উত্তম হবে।
এছাড়া বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসিলিম দেশে কদরের রাতে দল বেঁধে বিভিন্ন মসজিদে মসজিদে ঘোরাঘুরিকরাসহ উৎসবমুখর বিভিন্ন আয়োজন পরিলক্ষিত হয়। প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানভাইদের একটি কথা গুরুত্বের সঙ্গে মনে রাখতে হবে, মহিমান্বিত লাইলাতুল কদরে অহেতুক কোনো আয়োজনে লিপ্ত না হয়ে গোটা রাতের প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি মিনিটি এবং প্রতিটি ঘণ্টা কোরআন-সুন্নাহয় বর্ণিত বিভিন্ন ইবাদত বন্দেগীতে ব্যয় করার মাঝেই প্রকৃত সৌভাগ্য নিহিত।
পরিশেষ রাসুল (সা.)-এর কিছু হাদীস স্মরণ করিয়ে দেই। ইবনে মাজাহ শরিফে উল্লেখ রয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ‘শবে কদর’ থেকে বঞ্চিত হলো; সে যেন সমগ্র কল্যাণ থেকে পরিপূর্ণ বঞ্চিত হলো।’
আবু দাউদ শরিফে উল্লেখ আছে, হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ‘লাইলাতুল কদর’ পেল কিন্তু ইবাদত-বন্দেগীতে সময় কাটাতে পারলো না, তার মতো হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নেই।’
সুতরাং পবিত্র রমজানের মাসে লাইলাতুল কদর আপনার আমার দরজায় কড়া নাড়ছে। এ রাতটিকে খুঁজে আমল-ইবাদতে কাটিয়ে সৌভাগ্যবানদের তালিকাতে নাম লেখাবো নাকি হতভাগা থেকে যাবো; সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদেরকেই।
মহান আল্লাহ তা'আলা আমাদের সকলকে শবে কদরের পূর্ণ বরকত দান করুন।।আমিন।
প্রিয় দর্শক,,
আজকের ভিডিও এপর্যন্তই
এতক্ষন সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ,।
আসসালামুআলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ।
0 Comments