আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ
প্রিয় দর্শক
হযরত ফাতেমা রাঃ এর বিয়ের দিন কি ঘটেছিলো জানলে সত্যিই অবাক হবেন
হযরত ফাতেমাতুজ আল্লাহ জোহরা ( রাঃ ) আনহা পবিত্র মদীনা শরীফ গমন করার পর থেকে বিবাহের প্রস্তাব আসা শুরু হল । বহুদূর দুরান্তে হতে শিক্ষিত ধন্যবান ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সুদর্শন যুবক হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) -এর আদরের কন্যা কলিজার টুকরা হযরত ফাতেমাতুজ জোহরাকে ( রাঃ ) বিবাহ বন্দনে আবদ্ধ করার জন্যে অধীর আগ্রহে প্রস্তাব পাঠাতে লাগলেন । এমনকি আনসার ও মুহাজিররা রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) এর জন্যে জীবন উৎসর্গ করে রাসূলুল্লাহর কন্যা ফাতেমা ( রাঃ ) কে পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে । বিভিন্ন স্থান হতে প্রস্তাব আসলেও মহানবী কাউকে কোনরূপ কথা না দিয়ে মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন । কে দিতে পারবে আমার আদরের কন্যা নয়নের মণি কলিজার টুকরা হযরত ফাতেমাতুজ জোহরার ইজ্জত ও সম্মান । রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) দিবা রাত্রি বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করলেও তার মনের মধ্যে একই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে কার কাছে বিবাহ দিলে তার দীন ঈমান ও ইজ্জত আবরু রক্ষা পাবে । আল্লাহর রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) ফাতেমা ( রাঃ ) কে মূলত এমন একজন সৎ , যোগ্য জ্ঞানী , বুদ্ধিমান , শিক্ষিত , আল্লাহভীরু ন্যায়পরায়ণ , বিচক্ষণ ও সম্ভ্রান্ত ছেলের কাছে অর্পণ করতে রাসূলাল্লাহ ( সাঃ ) -এর মনের একান্ত প্রত্যাশা । দূর - দূরান্ত হতে যত প্রস্তাব আসুক না কেন কোন পাত্র রাসুলুল্লাহ ( সাঃ ) -এর চিন্তাও আশা অনুযায়ী হয় না । যার কারণে কাউকে কোন রূপ কথা না দিয়ে চুপ করে থাকেন । মূলত আল্লাহর রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) তার কলিজার টুকরার জন্যে কোন ধন্যবান পাত্র চান না । তিনি চান প্রকৃত ঈমানদার , হযরত ফাতেমা ( রাঃ ) এর শরীরের গঠন প্রকৃতি , সৌন্দর্য রূপস্তুণ ভদ্রতা , নম্রতা আচার ব্যবহার কথাবার্তা দানশীলতা , অতিথেয়তা , আমানতদারী , পিতা - মাতার আনুগত্যতা , ইবাদত গুজার , আল্লাহ ভীরুতা , তাকওয়া সুতীক্ষ্ম প্রজ্ঞা , চাল - চলন , কর্ম সম্পৃহা , শোয়া - বসা , খাওয়া - পরা , শিক্ষা - দিক্ষা , আদব- আখলাক , ধৈর্য , ধ্যান তপস্যা তাওয়াক্কুল ইত্যাদি রকমের মহৎ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রায় সকলের জানা ছিল । যার কারণে তাদের মধ্যে হতে অনেকেই হযরত ফাতেমা ( রাঃ ) কে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে পাওয়া জন্যে সরাসরি রাসূলূল্লাহ হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) এর প্রবিত্র দরবারে উপস্থিত হয়ে বুক ভরা আশা নিয়ে প্রস্তাব দিতেন । যোগ্যদের মধ্যে হতে সর্ব প্রথম হযরত আবু বকর ( রাঃ ) -এর পর হযরত উমর ফারুক ( রাঃ ) হযরত ফাতেমার ( রাঃ ) কে বিবাহ করার জন্যে আবেদন পেশ করলেন । তাদের বিশেষ আবেদন শুনা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) তাদের আবেদনের কোন জবাব দিলেন না । পরিশেষে সত্যের সৈনিক শেরে খোদা হযরত আলী ( রাঃ ) আবেদন করলেন হযরত আলী ( রাঃ ) আবেদন করার সাথে সাথে হযরত রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) বললেন , বিবাহের মোহরানা আদায় করার মতো তোমার নিকট কি আছে ? তখন হযরত আলী ( রাঃ ) বলিলেন একটি ঘোড়া ও একটি বর্ম ছাড়া আর কিছু নেই । হযরত আলী ( রাঃ ) এর সাহসী মনের সাহসী কথা শুনে হযরত রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) বললেন যুদ্ধের জন্যে অবশ্যই ঘোড়া দরকার বিধায় তুমি বর্মটি বিক্রি করতে পার । এরপর অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে হযরত আলী আদবের সাথে সেখান হতে বিদায় নিয়ে গেলেন । হযরত রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) যেমনি যোগ্য তার মনের মত পাত্র চেয়েছিলেন রাহমানুর রাহীম আল্লাহ তায়ালা তাই মিলায়ে দিলেন ।
হযরত আলী ( রাঃ ) -এর সাথে শুভ বিবাহ
হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) এর পবিত্র মুখের কথা ও নির্দেশ অনুযায়ী ইসলামের বীর সৈনিক হযরত আলী ( রাঃ ) হযরত ফাতেমা ( রাঃ ) -এর শুভ বিবাহের মহোর আদায় করার জন্যে খুশি মনে আপন লৌহ বর্ম বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং বর্মটি বিক্রি করার জন্যে গ্রাহকের সম্মান করতে লাগলেন । অনেক খোঁজাখুঁজি করেও উপযুক্ত গ্রাহক না পেয়ে বর্মটি নিয়ে পরের দিন হযরত আলী ( রাঃ ) হযরত রাসুলুল্লাহ ( সাঃ ) দরবারে উপস্থিত হলেন । ঐ মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) এর দরবারে হযরত আবুবক্কর সিদ্দিক ( রাঃ ) হযরত উমর ফারুক ( রাঃ ) হযরত উসমান যিন নুরাইন ( রাঃ ) সহ আর অনেক সাহাবা উপস্থিত ছিলেন । হযরত রাসুলুল্লাহ ( সাঃ ) নিজেই উপস্থিত সাহাবাদের লক্ষ্য করে বললেন , তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছ যে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে আলী ( রাঃ ) -এর বর্মটি ক্রয় করতে পার । রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) কথা শুনা মাত্রই কালবিলম্ব না করে হযরত উসমান ( রাঃ ) -দাঁড়িয়ে বললেন , হে রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) আমি ৪৮০ দিরহাম মূল্য দিয়ে বর্মটি ক্রয় করতে প্রত্যাশি । হযরত উসমান ( রাঃ ) -এর কথা অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) বর্মটা হযরত উসমান ( রাঃ ) -হাতে দিলেন হযরত উসমান ( রাঃ ) মনের খুশীতে নগদ ৪৮০ দিরহাম দিয়ে বর্মটি কিনে নিলেন এবং এই অর্থ রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) -এর সামনে রাখলেন । আল্লাহর রাসূলুল্লাহ টাকা নিয়ে হযরত আলী ( রাঃ ) -এর হাতে দিলেন । হযরত আলী ( রাঃ ) সেই টাকাগুলো দিয়ে বিবাহের যাবতীয় খরচ বহন করেন । এদিকে হযরত উসমান ( রাঃ ) আনন্দ মহূর্তে অত্যন্ত খুশী হয়ে হযরত আলী ( রাঃ ) কে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করার জন্যে লোহবর্মটি ফেরত দিলেন বর্মটি ফেরত দেওয়ায় হযরত আলী ( রাঃ ) আনন্দিত হলেন । রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) খুশী হয়ে হযরত উসমান ( রাঃ ) কে প্রাণ ভরে দোয়া করলেন । আর হযরত বেলাল ( রাঃ ) কে আতর ও খোশবু আনার জন্যে বাজারে পাঠালেন । কোন বর্ণনা হতে জানা যায় । রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) হযরত ওমর , সালমান ফারসী , সাদ ইবনে আবু ওক্কাস প্রমুখ সাহবাগণ ( রাঃ ) কে বাজারে পাঠিয়ে দু'টি বালিশ , একটি পরদা , এক খানা চাদর , দু'খানা বাসন দু'টি বাজু বদ্ধ , দু'টি পেয়ালা এবং একটা মাটির বাসন কিনে আনালেন । এদিকে হযরত আলী ( রাঃ ) প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে এনে উপস্থিত হলেন । এর পরে রাসূলুল্লাহ হযরত ( সাঃ ) এর নির্দেশে হযরত আলী ( রাঃ ) কে মসজিদের সামনে উপস্থিত করা হল । এর পরে রাসূল ( রাঃ ) নিজেই মিম্বরে বিবাহের খোতবা পাঠ করলেন । খোতবা শেষ করেই রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) উপস্থিত মেহমান সাহাবাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন তোমরা সকলেই জেনে রাখ এবং সাক্ষী থাক যে আমি চারশ দিরহাম মহরের বিনিময়ে আলী ইবনে আবু তালিবের সাথে আমার কন্যা হযরত ফাতেমাকে বিবাহ দিচ্ছি । এরপরে শেরে স্লোদ হযরত আলী ( রাঃ ) কে সম্বোধন করে বলেন আমি আমার কন্যা ফাতেমাতুজ জোহরাকে চারশ দিরহাম মহরের বিনিময় তোমার সঙ্গে বিবাহ দিলাম তুমি এতে সম্মতি আছ কি ? হযরত আলী ( রাঃ ) আদবের সঙ্গে উত্তর করলেন আল্লহামদুলিল্লাহ । আমি কবুল করলাম । এর পরে রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) উপস্থিত মেহমানদেরকে নিয়ে রাহমানুর রাহীম আল্লাহ তায়ালার দরবারে আবেগ জড়ান কণ্ঠে প্রার্থনা করলেন এবং দম্পতির সুখী হওয়ার জন্যে দোয়া করলেন । দোয়ার শেষে উপস্থিত মেহমানদের মধ্যে খেজুর বিতরণ করলেন । রাসূলুল্লাহজির নয়নের মনি হযরত ফাতেমা ( রাঃ ) শুভ বিবাহের সময় হযরত খাদীজাতুল কোবরা ( রাঃ ) ছাড়া রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) -এর যে সমস্ত স্ত্রী ছিলেন তারা সকলেই এই বিবাহের আসবাবপত্র সহ সকল ব্যবস্থা করেন । বিশেষ করে রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) -এর বিশেষ নির্দেশে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা ( রাঃ ) বিবাহের আনুষঙ্গিক কাজে সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করেন । তিনি ঘর দুয়ার লেপেদেন এবং বিছানা ঠিকঠাক করে দেন , এফাকি নিজ হাতে খেজুবের বাকল ধুনে বালিশ বানিয়ে দেন মেহমানদের সামনে । উন্মুল মু'মিনীন হযরত আয়েশা ( রাঃ ) , হযরত ফাতেমা ( রাঃ ) -এর বিবাহ সম্পর্কে বর্ণনা করতে যেয়ে বলেন , আমি ফাতেমা ( রাঃ ) -এর বিবাহের মত এমন সুন্দর ও উত্তম বিবাহ অনুষ্ঠান আর কোথাও দেখিনি । স্বামীর ঘরে হযরত ফাতেমা ( রাঃ ) -এর কর্ম ব্যস্ততা
হযরত আলী ( রাঃ ) -এর সঙ্গে হযরত রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) -এর কন্যা হযরত ফাতেমা ( রাঃ ) শুভ বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) প্রিয় জামাতা হযরত আলী ( রাঃ ) কে আপন হুজরায় নিয়ে গেলেন । হযরত আলী ( রাঃ ) ও ফাতেমা আলী ( রাঃ ) কে একত্রে নিজের কাছে বসালেন এবং প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলে এবং উপদেশ দিয়ে জামাতাকে উত্তমভাবে মেহমানদারী করালেন । এরপরে নিজের অযুর পানি জামাতা আলী ও ফাতেমার শরীরে ছিটিয়ে দিলেন । তারপর প্রিয় জামাতা হযরত আলী ( রাঃ ) কে নিজের ঘরে হযরত ফাতেমা ( রাঃ ) এর সঙ্গে একত্রে রাত্রি যাপন করতে দিলেন । আল্লামা সোলায়মান নদভী ( র ) সাহাবা চরিত্রে বর্ণনা করেন যে বিবাহের পূর্বে হযরত আলী ( রাঃ ) রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) -এর সঙ্গে অবস্থান করতেন এবং রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) -এর ঘরে অবস্থান করেন । কোন কোন বর্ণনা হতে জানা যায় বিবাহের পরে হযরত আলী ( রাঃ ) প্রায় দশ এগারমাস রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) এর সঙ্গে অতিবাহিত করেন । হযরত ফাতেমা ( রাঃ ) পিত্রালয়ে থাকাকালীন সাধ্যানুযায়ী স্বামীর খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন । মেয়ে ও জামাতার মধ্যে যেন মধুর সম্পর্ক সৃষ্টি হয় সে দিকে রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) বিশেষভাবে খেয়াল রাখতেন । বিবাহের পর হযরত ফাতেমা ( রাঃ ) পিতার বাড়িতে প্রায় এগারটি মাস অতিবাহিত করেন । হযরত ফাতেমা ( রাঃ ) -এর বিবাহের সময় ও বয়স অধিকাংশ সীরাত বর্ণনা কারীদের মতে হযরত রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) দ্বিতীয় হিজরী সনে হযরত আলী ( রাঃ ) -এর সঙ্গে হযরত ফাতেমা ( রাঃ ) -এর শুভ বিবহারে কার্য সুসম্পন্ন হয় । তাদের এই পবিত্র বিবাহ মসজিদে নব্বীতে হয়েছিল । তরকাতে ইবনে সাদ ও খোলাফায়ে রাশেদীনে উল্লিখিত আছে যে শুভ বিবাহের সময় রাসূলুল্লাহ কন্যা হযরত ফতেমাতুজ জহরার ( রাঃ ) বয়স হয়েছিল কেবলমাত্র ১৪ বছর । অন্যদিকে শেরে খোদ ! হযরত আলী ( রাঃ ) বয়স হয়েছিল মাত্র ২৩ বছর । আল্লামা শিবলি নোমান ও সৈয়দ সোলায়মান নদভী ( র ) সীরাতুননবী কিতাবের দ্বিতীয় খণ্ডে উল্লেখ করেছেন যে হযরত আলী ( রাঃ ) যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তখন তার বয়স হয়েছিলমাত্র একুশ বছর পাঁচমাস মতান্তরে চব্বিশ বছর । এর মধ্যে প্রথম মতটিই সর্বাধিক সহীহ ও গ্রহণযোগ্য । দ্বিতীয় হিজরী সনের ব্যাপারে কারো কোন মন্তব্য নেই।
0 Comments