Header Ads Widget

Responsive Advertisement

ফাতেমা রাঃ এর কষ্টের রোজ


আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ

প্রিয় দর্শক 

হযরত ফাতেমা রাঃ রাসুল সাঃ এর কন্যা হওয়া সত্ত্বেও যে কষ্টে দিন অতিবাহিত করতেন জানলে অবাক হবেন 


যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হন। এরপর মহান আল্লাহর নির্দেশে গোপনে তিন বছর মানুষকে ধর্মের দিকে দাওয়াত দিতে থাকেন। তিন বছর পর তিনি প্রকাশ্যে নিজের আত্মীয়-স্বজন ও মক্কাবাসীকে ধর্মের পথে দাওয়াত দেন। রাসূলের গোত্র বনু হাশিমের মধ্য থেকে তাঁর চাচা আবু লাহাব তাঁর বিরোধিতা করতে থাকে। আর মক্কার নেতৃস্থানীয় কুরাইশরা সকলে রাসূলের সাথে শত্রুতা শুরু করে।


এর মধ্যে রাসূলের পুত্রসন্তানরা মারা গেলে কাফির-মুশরিকরা রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা করতে থাকে। আস ইবনে ওয়ায়েল রাসূলকে ‘আবতার’ (লেজকাটা) বা নির্বংশ বলে গালি দেয়। সে বলত,‘আরে মুহাম্মাদের তো কোন পুত্রসন্তান নেই,সে মরে গেলে তার নাম নেয়ার মতো ও কেউ থাকবে না।’ রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এ কথায় খুব কষ্ট পেতেন। মহান আল্লাহ্ তাঁর এ কষ্ট দূর করার জন্য যে অমূল্য নেয়ামত তাঁকে দান করেন তিনিই হলেন হযরত ফাতিমা (আ.)। এর প্রেক্ষিতেই পবিত্র কুরআনের সূরা কাওসার নাযিল হয়।


হযরত ফাতিমার জীবনযাপন প্রণালী


যুহ্দ বা দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ততা


ইমাম জা’ফর আস সাদেক (আ.) এবং হযরত জাবের আনসারী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,একদিন হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত ফাতেমাকে দেখলেন যে,তিনি একটি মোটা ও শক্ত কাপড় পরিধান করে নিজ হস্তে যাঁতাকল চালিয়ে আটা তৈরী করছেন। আর সে অবস্থায় নিজের কোলের সন্তানকে দুধ খাওয়াচ্ছেন। এহেন অবস্থা পরিদর্শনে হযরতের চোখে পানি ছল ছল করে উঠলো। তখন তিনি বলেন : “আমার হে প্রিয় কন্যা! এ দুনিয়ার তিক্ততা আখেরাতের মিষ্টি স্বাদেরই পূর্ব প্রস্তুতি মনে করে সহ্য করে যাও।” প্রত্যুত্তরে হযরত ফাতেমা বলেন :


হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আল্লাহ্ প্রদত্ত এতসব নেয়ামত ও অনুগ্রহের জন্যে তাকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই এবং এ জন্যে তাঁর অশেষ প্রশংসাও করছি। তখন আল্লাহ্ নিম্নোক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ করেন :


)وَ لَسَوْفَ يُعْطِيْكَ رَبُّكَ فَتَرْضَى(


অর্থাৎ তোমার প্রভু অতি শীঘ্রই তোমাকে এতসব কিছু দেবেন যার ফলে তুমি সন্তুষ্ট হবে।”২২


গৃহাভ্যন্তরে কাজ


ইমাম জা’ফর সাদিক (আ.) বলেন : “ইমাম আলী (আ.) পানি ও কাঠ জোগাড় করে আনতেন আর হযরত ফাতেমা (আ.) আটা তৈরী করে খামির বানাতেন আর তা দিয়ে রুটি তৈরী করতেন। তিনি কাপড়ে তালি লাগানোর কাজও করতেন। এ মহিয়সী রমণী সকলের চেয়ে বেশী রূপসী ছিলেন এবং তাঁর পবিত্র গাল দু’টি সৌন্দর্যে পুষ্পের ন্যায় ফুটে ছিল। আল্লাহর দরূদ তিনি সহ তাঁর পিতা,স্বামী ও সন্তানদের উপর বর্ষিত হোক।”২৩


হযরত আলী (আ.) বলেছেন : “ফাতেমা মশক দিয়ে এতই পানি উত্তোলন করেছেন যার ফলে তাঁর বক্ষে ক্ষতের ছাপ পড়ে যায়,তিনি হস্তচালিত যাতাকলের মাধ্যমে এত পরিমান আটা তৈরী করেছেন যার কারণে তাঁর হাত ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়,তিনি এত পরিমান ঘর রান্না-বান্নার কাজ করেছেন যে তাঁর পোশাক ধুলি  ধোঁয়া মাখা হয়ে যেত। এ ব্যাপারে তিনি প্রচুর কষ্ট স্বীকার করেছেন।”২৪ (উল্লেখ্য যে তিনি মদীনার দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত মানুষদের মধ্যে বিতরণের জন্য প্রতিদিনই রুটি প্রস্তুত করতেন।)


দাম্পত্য জীবনে পারস্পরিক সমঝোতা


আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.) বলেন : “আল্লাহর শপথ,আমার দাম্পত্য জীবনে ফাতেমাকে তাঁর মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কখনো রাগাইনি আর কোন কাজে তাকে বাধ্য করি নি। সেও আমাকে কখনো রাগান্বিত করে নি এবং কখনো আমার অবাধ্য হয় নি। যখনি তাঁর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতাম তখনি আমার দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে যেত।”২৫


ইবাদত ও অপরের জন্যে দোয়া


হযরত হাসান বসরী (রহ.) বলেন : “নবী (সা.)-এর উম্মতের মধ্যে হযরত ফাতেমার ন্যায় ইবাদতকারী পৃথিবীতে আর আসেনি। তিনি নামাজ ও ইবাদতে এতবেশী দণ্ডায়মান থাকতেন যে,ফলে তাঁর পদযুগল ফুলে গিয়েছিল।”২৬


ইমাম হাসান (আ.) বলেন : “এক বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্রে আমার মাকে ইবাদতে দণ্ডায়মান দেখতে পেলাম। তিনি সুবহে সাদেক পর্যন্ত নামাজ ও মুনাজাতরত ছিলেন। আমি শুনতে পেলাম যে,তিনি মু’মিন ভাই-বোনদের জন্যে তাদের নাম ধরে দোয়া করলেন কিন্তু নিজের জন্যে কোন দোয়াই করলেন না। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম,মা! আপনি যেভাবে অন্যের জন্যে দোয়া করলেন সেভাবে কেন নিজের জন্যে দোয়া করলেন না? উত্তরে তিনি বলেন : হে বৎস! প্রথমে প্রতিবেশীদের জন্যে তারপর নিজেদের জন্যে।”২৭


পর্দা


ইমাম মুসা কাযেম (আ.) তাঁর পিতা ও পিতামহদের কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন যে হযরত আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.) বলেছেন : “একদিন এক অন্ধ ব্যক্তি ফাতেমার গৃহে প্রবেশের জন্যে অনুমতি চাইলে তিনি ঐ অন্ধ ব্যক্তি থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখলেন । রাসূল (সা.) বললেন : হে ফাতেমা! কেন তুমি এই ব্যক্তি থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখছো,সে তো অন্ধ,তোমাকে দেখছে না।? প্রতি উত্তরে ফাতেমা বলেন : যদিও ঐ অন্ধ লোকটি আমাকে দেখছেন না কিন্তু আমি তো তাকে দেখছি। এ অন্ধ ব্যক্তিটির নাসিকা গ্রন্থি তো কাজ করছে। তিনি তো ঘ্রান নিতে পারেন। এ কথা শুনে রাসূল (সা.) বলেন : আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,তুমি আমার দেহের অংশ।”২৮


সতীত্ব এবং বেগানা পুরুষ থেকে দূরত্ব বজায় রাখা


হযরত ফাতেমা (আ.)-কে প্রশ্ন করা হয়,“একজন নারীর জন্য সর্বোত্তম জিনিস কোনটি?” তিনি এর উত্তরে বলেন : “নারীদের জন্যে সর্বোত্তম জিনিস হলো তারা যেন কোন পুরুষকে না দেখে আর পুরুষরাও যেন তাদেরকে দেখতে না পায়।”২৯


তদ্রুপ মহানবী (সা.) যখন তাঁর সাহাবীদের সামনে প্রশ্ন রাখেন যে,“একজন নারী কখন মহান আল্লাহর সবচেয়ে নৈকট্য লাভে সক্ষম হন?” তখন হযরত ফাতেমা বলেন : নারী যখন বাড়ীর সর্বাপেক্ষা গোপন অংশে অবস্থান গ্রহণ করে তখন তার প্রভুর সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়। হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত ফাতেমার উত্তর শ্রবন করে বলেন : “ফাতেমা আমার শরীরের অংশ।”৩০


হ্যাঁ,এটা সুস্পষ্ট যে যতক্ষণ পর্যন্ত একজন নারীর গৃহের বাইরে আসার কারণে কোন হারাম বা নিষিদ্ধ কাজ সংঘটিত না হয় ততক্ষণ তার বহিরাগমনে কোন আপত্তি নেই। কখনো কোন কাজের জন্যে নারীর বহিরাগমনের দিকটা কল্যাণকর হয়ে থাকে আবার কখনো অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। উপরোল্লিখিত রেওয়ায়েতগুলোর অর্থ হচ্ছে কোন প্রয়োজনীয় কাজ ব্যতীত একজন নারীর গৃহের বাইরে পর-পুরুষের দৃষ্টির সামনে নিজেকে উপস্থাপন করা অনুচিত।


গৃহভৃত্যের সাথে কাজের ভাগাভাগি


হযরত সালমান ফারসী বলেন : একবার হযরত ফাতেমা হস্তচালিত যাঁতাকল দিয়ে আটা তৈরী করছিলেন। আর যাঁতাকলের হাতল ফাতেমার হাতের ক্ষতস্থান দ্বারা রক্তরঞ্জিত হয়ে গিয়েছিল। তখন শিশু হুসাইন তাঁর পার্শ্বে ক্ষুধার জ্বালায় ক্রন্দন করছিল। আমি তাকে বললাম : “হে রাসূলের দুহিতা! আপনার হাত ক্ষত হয়ে গেছে,‘ফিদ্দা’ (হযরত ফাতেমার গৃহপরিচারিকার নাম) তো আপনার ঘরেই আছে।” তখন তিনি বলেন : “রাসূল (সা.) আমাকে আদেশ করেছেন যে পালাক্রমে একদিন ফিদ্দা ঘরের কাজ করবে আর আমি অন্য একদিন। তার পালা গতকাল শেষ হয়ে গেছে আর আজকে আমার পালা।”৩১


দুনিয়া ত্যাগ ও আল্লাহর ভয়


যখন,


)وَ إِنَّ جَهَنَّمَ لَمَوْعِدُهُمْ أَجْمَعِيْنَ  لَهَا سَبْعَةُ أَبْوَابٍ لِكُلِّ بَابٍ مِنْهُمْ جُزْءٌ مَقْسُوْمٌ(


অর্থাৎ এবং নিশ্চয়ই জাহান্নাম তাদের সকলের জন্যে প্রতিশ্রুত স্থান। তার সাতটি দ্বার আছে। যার প্রত্যেক দ্বারের জন্যে তাদের অন্তর্ভুক্ত স্বতন্ত্র দল থাকবে।৩২


এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় তখন আল্লাহর রাসূল (সা.) উচ্চস্বরে ক্রন্দন করেছিলেন। আর তাঁর সাহাবীরাও তাঁর কান্না দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। কিন্তু তারা জানতেন না যে হযরত জিবরাঈল (আ.) রাসূল (সা.) উপর কি অবতীর্ণ করেছেন। মহানবী (সা.) ভাবগম্ভীর অবস্থা দেখে তাকে কেউ কিছু প্রশ্ন করার সাহস পায় নি। হযরত মুহাম্মদ (সা.) যখনি হযরত ফাতিমাকে দেখতেন তখনি আনন্দিত হয়ে উঠতেন। তাই হযরত সালমান ফারসী মহানবী (সা.)-এর এহেন অবস্থার সংবাদ হযরত ফাতেমাকে প্রদান করার জন্যে তাঁর গৃহাভিমুখে যাত্রা করেন। হযরত সালমান ফারসী তাঁর গৃহে পৌঁছে দেখেন যে হযরত ফাতেমা যাঁতায় আটা তৈরী করছেন,আর


)وَ مَا عِنْدَ اللهِ خَيْرٌ وَ أَبْقَى(


অর্থাৎ আল্লাহর নিকট যা আছে তা কল্যাণকর এবং তাই অবশিষ্ট থাকবে।৩৩


এ আয়াতটি পাঠ করছেন। তাঁর পরনে একটি পশমী আবা,যার বার জায়গায় খেজুরের আঁশ দ্বারা তালি লাগানো ছিল।


হযরত সালমান ফারসী হযরত ফাতেমার কাছে নবী (সা.)-এর অবস্থা এবং হযরত জিবরাঈল (আ.) যে কিছু নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন-তা খুলে বললেন। হযরত ফাতেমা উঠে দাঁড়ালেন এবং সেই তালি দেয়া আবা পড়েই বাবার কাছে রওয়ানা হলেন। হযরত সালমান ফারসী হযরত ফাতেমার পরনে এ ধরনের কাপড় দেখে ভীষণ কষ্ট পেলেন। তিনি বলেন : হায়! রোমান ও পারস্য সম্রাটদের কন্যারা রেশমী কাপড় পরিধান করে আর মুহাম্মদ (সা.) কন্যার পরনে পশমী আবা,যার বারো স্থানে তালি লাগানো আছে! হযরত ফাতেমা (আ.) বাবার কাছে পৌঁছে সালাম দিয়ে বললেন : “হে পিতা! সালমান আমার পোশাক দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। সেই আল্লাহর শপথ! যিনি আপনাকে নবুওয়াত প্রদান করেছেন,পাঁচ বৎসর যাবৎ এই একটি দুম্বার চর্ম ছাড়া আমাদের অন্য কিছু নেই-যার উপর দিনের বেলা উটের খাবার রাখি আর রাত্রিতে এটাই আমাদের বিছানা। আমাদের বালিশ একটি চামড়া দ্বারা তৈরী যার ভিতরে খেজুরের আঁশ দিয়ে ভর্তি করা হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন : হে সালমান! আমার মেয়ে আল্লাহর পথে অগ্রগামীদের অন্তর্ভূক্ত। হযরত ফাতেমা পিতাকে প্রশ্ন করেন : “বাবা আপনার জন্যে আমার জীবন উৎসর্গ হোক! বলুন,কি কারণে আপনি ক্রন্দন করেছিলেন?” তখন রাসূল (সা.) হযরত জিবরাঈল কর্তৃক অবতীর্ণ আয়াতটি পাঠ করেন। হযরত ফাতেমা আয়াতটি শ্রবণ করে এমনভাবে ক্রন্দন করেন যে মাটিতে পড়ে যান। তখন থেকে অনবরত তিনি বলতেন : হায়! হায়! যার জন্যে জাহান্নামের আগুন  নির্দ্ধারিত হবে তার অবস্থা কেমন হবে..।৩৪

Post a Comment

0 Comments