আসসালামুআলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ।
প্রিয় দর্শক ,,
একদিন শয়তান আল্লাহ্র দরবারে আরজ করে বলল, হে খোদা! আমি তোমার কছম খেয়ে বলতে পারি আইয়ুব নবী একমাত্র তোমার প্রদত্ত ধন-সম্পদের লোভে ও আরাম-আয়েশের তৃপ্তিতে তোমার এবাদাত বন্দেগী করে থাকে। যদি তাঁর এ ধন-সম্পদ ও সুখ শান্তি বিলিন হয়ে যায় তাহলে একদিনও সে এবাদাতে লিপ্ত হবে না। হে খোদা! তুমি নবীর উপর হস্তক্ষেপ করার মত ক্ষমতা আমাকে দাও। আমি একটু দেখি আইয়ুব তোমার কতটা বিশ্বস্ত নবী।
আল্লাহ্ তা’য়ালা শয়তানকে জানিয়ে দিলেন, যাও তোমাকে নবীর উপর হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা প্রদান করা হল। তোমার যে ভাবে ইচ্ছা সেভাবে নবীকে পরীক্ষা করতে পার। শয়তান আল্লাহ্র প্রদত্ত ক্ষমতা পেয়ে একের পর এক পরিক্ষা নিতে লাগল হযরত আইয়ূব আঃ এর।
হযরত আইয়ুব (আ)-এর ঐ সব সম্পদ ছাড়াও আরও ছিল প্রচুর সন্তান ও পরিবার-পরিজন। পরে এ সব কিছু তার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নানা প্রকার দৈহিক ব্যাধি দ্বারা তাকে পরীক্ষায় ফেলা হয়। শরীরের সর্ব অংগে রোগ ছিল এত ব্যাপক যে, জিহবা ও হৃৎপিণ্ড ব্যতীত কোন একটি স্থানও অক্ষত ছিল না। এ দুই অংগ দ্বারা তিনি আল্লাহর যিকির করতেন। এতসব মুসীবত সত্ত্বেও তিনি ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখান। রাত-দিন সকাল-সন্ধ্যা সর্বক্ষণ আল্লাহর যিকিরে রত থাকেন। রোগ দীর্ঘ স্থায়ী হওয়ায় বন্ধু-বান্ধব, আপনজন তার কাছ থেকে সরে যেতে থাকে। অবশেষে তাকে শহরের বাইরে এক আবর্জনাময় স্থানে ফেলে রাখা হয়। একে একে সবাই তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একমাত্র স্ত্রী ছাড়া অন্য কেউ তার খোঁজ-খবর রাখত না। স্বামীর অধিকার, তার পূর্বের ভালবাসা ও অনুগ্রহের কথা মনে রেখে স্ত্রী তার সেবায় নিয়োজিত থাকেন। স্ত্রী তার অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। পেশাব-পায়খানায় সাহায্য করতেন এবং অন্যান্য খিদমতে আঞ্জাম দিতেন। স্ত্রীও ক্রমশ দুর্বল হতে থাকেন। অর্থের দৈন্য দেখা দেয়। ফলে মানুষের বাড়িতে কাজ করে সেই পারিশ্রমিক দ্বারা স্বামীর আহার্য ও ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হন। তবুও তিনি অসীম ধৈর্যের পরিচয় দেন। সম্পদ ও সন্তানাদি হারান। স্বামীর করুণ অবস্থা, অর্থের অভাব ও মানুষের সাহায্য-সহানুভূতির অনুপস্থিতি— এ সব প্রতিকূল অবস্থাকে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে মুকাবিলা করেন। অথচ সম্পদ-ঐশ্বর্য, বন্ধু-বান্ধব ইতিপূর্বে সবই তাদের করায়ত্ত ছিল।
সহীহ হাদীসে আছে— রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন :
সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা হয় নবীগণের। তারপর সত্যপন্থী লোকদের, এরপর দীনদাদীর স্তর ভেদে পর্যায়ক্রমে এ পরীক্ষা চলে। যদি সে দৃঢ়তার সঙ্গে দীনের আনুগত্য করতে থাকে। তবে তার পরীক্ষাও কঠোরতর হয়।’ উল্লেখিত বিপদ-আপদ হযরত আইয়ুব (আঃ)-এর ক্ষেত্রে যতই বৃদ্ধি পেয়েছে ততই তার ধৈর্য, সহনশীলতা, আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি তার ধৈর্য ও মুসীবত পরবর্তীকালে প্রবাদে পরিণত হয়ে যায়। ওহাব ইব্ন মুনাব্বিহ ও অন্য অনেকে ইসরাঈলী উলামাদের বরাতে হযরত আইয়ুব (আঃ)-এর সম্পদ ও সন্তানাদি নিঃশেষিত হওয়া ও দেহের রোগ সম্পর্কে দীর্ঘ বর্ণনা দান করেছেন। আল্লাহ। এগুলোর বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত।
মুজাহিদ (র) বলেছেন, পৃথিবীতে হযরত আইয়ুব (আ)-এরই সর্বপ্রথম বসন্ত রোগ হয়। ঐতিহাসিকগণ হযরত আইয়ুব (আ)-এর পরীক্ষাকালের স্থায়িত্ব সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন। ওহাবের মতে, তার পরীক্ষাকাল ছিল তিন বছর- এর কমও নয়, বেশিও নয়। আনাস (রা) বলেন, সাত বছর কয়েক মাস পর্যন্ত তার পরীক্ষা চলে।
হুমায়াদ (র) বলেছেন, হযরত আইয়ুব (আ) আঠার বছর যাবত মুসীবতে আবদ্ধ ছিলেন। সুদী (র) বলেছেন, আইয়ুব (আ)-এর দেহ থেকে মাংস খসে পড়ে এমনকি তার হাড় ও শিরা ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। তাঁর স্ত্রী তাঁর দেহের নিচে ছাই বিছিয়ে দিতেন। এ অবস্থা যখন দীর্ঘ দিন ধরে চলতে থাকে, তখন একদা স্ত্রী বললেন, হে আইয়ুব! আপনি যদি আপনার প্রতিপালকের কাছে দু’আ করতেন তাহলে তিনি এ বিপদ থেকে আপনাকে উদ্ধার করতেন। তদুত্তরে আইয়ুব (আ) বললেন, আমি সত্তর বছর সুস্থ দেহে জীবন যাপন করেছি, এখন তার জন্যে সত্তর বছর সবর করলেও তা নগণ্যই হবে। স্বামীর মুখে এ কথা শুনে স্ত্রী ঘাবড়ে যান। তখন থেকে তিনি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মানুষের কাজকর্ম করে আইয়ুব (আ)-এর আহার্যের ব্যবস্থা করতেন।
কিছুদিন পর লোকজন যখন জানল যে, এই মহিলাটি আইয়ুব (আ)-এর স্ত্রী। তখন আর তারা তাঁকে কাজে নিতো না। তাদের ভয় হল যে, এরূপ মেলামেশার দ্বারা আইয়ুবের রোগ হয়ত তাদের মধ্যে সংক্রামিত হতে পারে। একদা স্ত্রী কোথাও কাজ খুঁজে না পেয়ে অবশেষে জনৈক সম্রান্ত ব্যক্তির কন্যার কাছে খুব উন্নতমানের খাদ্যের বিনিময়ে নিজের চুলের দুইটি বেনীর একটি বিক্রি করে দেন। উক্ত খাদ্য নিয়ে তিনি আইয়ুব (আঃ)-এর কাছে উপস্থিত হন। আইয়ুব (আ) এমন খাদ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ খাদ্য কোথায় পেয়েছো? স্ত্রী জানালেন, অন্যের কাজ করে এ খাদ্য সংগ্রহ করেছি। পরের দিনও স্ত্রী কোথাও কাজ না পেয়ে অবশিষ্ট বেনীটিও খাদ্যের বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। উক্ত খাদ্য আইয়ুব (আ)-এর কাছে নিয়ে আসলে এবারও তিনি অসন্তুষ্ট হন এবং কসম করেন যে, কোথা থেকে কিভাবে এ খাদ্য তিনি পেলেন, না বলা পর্যন্ত তিনি তা খাবেন না। তখন স্ত্রী নিজ মাথা থেকে ওড়না তুলে দেখান। আইয়ুব (আ) স্ত্রীর মাথা মুণ্ডিত দেখে আল্লাহর কাছে দু’আ করেন :
হে আমার প্রতিপালক! আমি দুঃখে-কষ্টে পতিত হয়েছি, আর আপনি তো সকল
দয়ালুদের শ্রেষ্ঠ দয়ালু। (সূরা আম্বিয়া : ৮৩)
ইব্ন আবী হাতিম (র) আবদুল্লাহ ইব্ন উবায়দ ইব্ন উমােয়র (রা) থেকে বর্ণনা করেন, হযরত আইয়ুব (আ)-এর দুই ভাই ছিল। একদা তারা তাদের ভাইকে দেখতে আসে। কিন্তু আইয়ুব (আঃ)-এর দেহের দুর্গন্ধের কারণে তারা তার কাছে যেতে সক্ষম হলো না। দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন একজন অপর জনকে বলল : আইয়ুবের মধ্যে কোন কল্যাণ আছে বলে যদি আল্লাহ জানতেন, তাহলে তিনি এভাবে তাকে এরূপ কঠিন পরীক্ষায় ফেলতেন না। তাদের এ কথায় তিনি এতই মর্মাহত হন যে, এমনটি আর কখনও হননি। অতঃপর তিনি আল্লাহর কাছে দু’আ করলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি যদি জানেন যে, এমন একটি রাতও যায়নি, যে রাত্রে আমি পেট ভরে খানা খেয়েছি অথচ আমার জানা মতে, কোন ব্যক্তি ক্ষুধার্ত অবস্থায় থেকেছে, তা হলে আমার সত্যতা প্ৰকাশ করুন।’ তখন আকাশ থেকে তার কথার সত্যতা ঘোষণা করা হয়।
এবং ঐ দুই ভাই তা শ্রবণও করে। অতঃপর তিনি পুনরায় বললেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি যদি জানেন যে, বস্ত্ৰহীন লোকের খবর পাওয়ায় আমি কখনও দুটি জামা গ্ৰহণ করিনি তাহলে আমার সত্যতা প্রকাশ করুন।’ তখন আকাশ থেকে তাঁর সত্যতা ঘোষণা করা হয়— যা ঐ দুই ভাই শ্ৰবণ করেছিল।
আল্লাহর নবী সাহস করতেননা আল্লাহর কাছে রােগ মুক্তির দোয়া করতে। বিষয়টি ধৈর্যের খেলাফ হয় কিনা এমনটি ভেবে। তারপর তিনি একদিন । অত্যন্ত বিনয় ও নম্রতা সুলভভাবে। কয়েকটি বাক্য উচ্চারণ করলেন এভাবে। হে আমার প্রতিপালক ! আমি রােগাক্রান্ত হয়ে পড়েছি। আমাকে বেশ দুঃখ কষ্ট পেয়ে বসেছে । আপনিতাে সবচেয়ে বেশি দয়াবান। এরকম আবেগপূর্ণ অথচ সম্পূর্ণ গােলামী আহ্বান। করুণার সৃষ্টি হলাে দয়াবান আল্লাহর দয়ার দরিয়ায়। সৃষ্টি হলাে মহব্বতের ঢেউ।
আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীর আহ্বানে সাড়া দিলেন। নবী হযরত আইউব কে আল্লাহ বললেন। হে আইউব! তােমার পায়ের গােড়ালী দিয়ে আঘাত করাে মাটিতে। হযরত আইউব আলাইহিসসালাম আল্লাহর নির্দেশে তাই করলেন। আঘাত করায় ঝর্ণাধারা সৃষ্টি হলাে পায়ের কাছে। সৃষ্টি হলাে ঝর্ণা । সুশীতল পানির ঝর্ণা। গােসল আর খাওয়ার জন্য। তিনি গােসল দিলেন এবং পান করলেন। এটিই ছিলাে তাঁর রােগমুক্তির মহা ঔষধ। দূর হয়ে গেলাে তাঁর দুঃখ-কষ্ট। রােগ থেকে পেলেন মহামুক্তি।
শুধু রােগমুক্তিই নয়। তাকে আবার ফিরিয়ে দেয়া হলাে পরিবার পরিজন । পাড়া-প্রতিবেশী । আত্মীয়স্বজন। ফিরে পেলেন সহায় সম্পদ। কাছে ভিড়লাে বন্ধু-বান্ধব । বৃদ্ধি পেলাে আরাে সন্তান-সন্ততি। এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ শিক্ষা দিলেন মুসলিম উম্মাহকে। পরিবার-পরিজন। সন্তান- সন্ততি। অর্থ-বিত্ত ও সুন্দর স্বাস্থ্য সবই মহান আল্লাহর অপূর্ব নিয়ামত । তিনি যাকে ইচ্ছা প্রচুর পরিমাণে দান করেন। আবার ছিনিয়েও নেন। এটা শুধু মাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহর পক্ষেই সম্ভব। আর পরীক্ষা করেন কে ধৈর্যশীল? কে শােকর আদায়কারী? কে হতাশাগ্রস্ত? আবার কে হয় নাফরমান? কে থাকবে বিপদে-আপদে কাছে? কে সরে যাবে দূর থেকে বহু দূরে? তা প্রমাণ হয়ে যাবে বিপদ মূহূর্তে? এটাই আল্লাহর শিক্ষা। (সূরা সা'দ অবলম্বনে)।
সুখে-দুঃখে তথা জীবনের সকল অবস্থায় মানুষের জন্য উচিৎ তাদের প্রতিপালকের শোকর আদায় করা, জীবনে সুখ-সম্মৃদ্ধি আসলে আল্লাহ তা‘আলার রহমত বলে গণ্য করা। আর যদি কোনো প্রতিকুল পরিবেশ বা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় তাহলে ধৈর্যধারণ করা। কেননা আল্লাহর প্রতি অভিযোগ নবী-রাসূলগণের শিক্ষা পরিপন্থী।
মানুষের জন্য উচিৎ কোনো অবস্থাতেই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়া। নিরাশ হওয়া কুফুরী। যেমন, আল্লাহর বাণী:
‘‘আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না, আল্লাহ সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দিবেন।’’ [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৫৩]
স্ত্রীর জন্য উচিৎ সর্বদা স্বামীর খিদমতে নিয়োজিত থাকা, সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় স্বামীর পাশে থাকা, নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে হলেও স্বামীর সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং তার সেবায় নিয়োজিত থাকা। যা আমরা আয়্যুব ‘আলাইহিস সালামের ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি, যেমন আইয়ূব ‘আলাইহিস সালামের পবিত্রা স্ত্রী ‘রাহমা’ করেছিলেন।
ইব্ন জারীর (র) প্রমুখ ইতিহাসবেত্তা লিখেছেন যে, হযরত আইয়ুব (আ) তিরানব্বই বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। কারও মতে, তিনি এর চেয়ে বেশিদিন জীবিত ছিলেন। মুজাহিদ (র) বৰ্ণনা করেন যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ দলীল হিসেবে ধনীদের বিরুদ্ধে সুলায়মান (আ)-কে, দাস-দাসীদের বিরুদ্ধে ইউসুফ (আঃ)-কে এবং মুসীবত ও বিপদগ্ৰস্তাদের মুকাবিলায় আইয়ুব (আ)-কে পেশ করবেন।
0 Comments